ঘর্ষণ (Friction)

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - পদার্থবিদ্যা - পদার্থবিজ্ঞান – ১ম পত্র | NCTB BOOK

একটি খেলনা মোটরকে মাটির ওপর গড়িয়ে দিলে যতদূর যাবে সিমেন্টের মেঝের ওপর তার থেকে বেশি দূর যাবে। আবার মসৃণ মেঝেতে পুরানো জুতা পায়ে চলতে যত সুবিধা নতুন জুতা পায়ে তত নয়। এর কারণ কী? কোনো বস্তু আপাতদৃষ্টিতে যতই মসৃণ মনে হোক না কেন কোনো বস্তুই কিন্তু সম্পূর্ণ মসৃণ হতে পারে না। সব থেকে মসৃণ বস্তুর তলও খানিকটা উঁচু নিচু। ফলে যখন কোনো বস্তু অপর বস্তুর ওপর দিয়ে চলার চেষ্টা করে তখন বস্তু দুটির উঁচু নিচু খাঁজগুলো পরস্পরের সাথে আটকে যায়, ফলে গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় বা ঘর্ষণের উৎপত্তি হয়। আবার বস্তুদ্বয়ের তল যে স্থানে স্পর্শ করে থাকে সে স্থানের অণুগুলো পরস্পরকে আকর্ষণ করে, এর ফলেও তলদ্বয়ের মধ্যবর্তী গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। যে বল দ্বারা গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় তাকে ঘর্ষণ বল বলে।

সংজ্ঞা : দুটি বস্তু পরস্পরের সংস্পর্শে থেকে যদি একের ওপর দিয়ে অপরটি চলতে চেষ্টা করে তাহলে বস্তুদ্বয়ের স্পর্শ তলে এই গতির বিরুদ্ধে একটা বাধার উৎপত্তি হয়, এই বাধাকে ঘর্ষণ বলে ।

ঘর্ষণ সাধারণত চার প্রকারের হয়ে থাকে : 

১। স্থিতি ঘর্ষণ (Static Friction),

২। গতীয় ঘর্ষণ বা বিসর্প-ঘর্ষণ (Kinetic Friction or Sliding Friction).

৩। আবর্ত ঘর্ষণ (Rolling Friction) এবং ৪। প্রবাহী ঘর্ষণ (Fluid Friction)।

ঘর্ষণ বল দুটি বস্তু পরস্পরের সংস্পর্শে থেকে যদি একের ওপর দিয়ে অপরটি চলতে চেষ্টা করে তাহলে বস্তুদ্বয়ের স্পর্শতলে এই গতির বিরুদ্ধে যে বল উৎপন্ন হয়, তাকে ঘর্ষণ বল বলে। 

স্থিতি ঘর্ষণ ও সীমান্তিক ঘর্ষণ 

Static Friction and Limiting Friction

মনে করি, M একটি কাঠের ব্লক সমতল টেবিলের ওপর আছে (চিত্র ৪.২৯) । এই অবস্থায় ব্লকের ওজন W টেবিলের ওপর খাড়া নিচের দিকে ক্রিয়া করছে এবং নিউটনের তৃতীয় সূত্রানুসারে টেবিলও ব্লকের ওপর সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া R প্রয়োগ করবে। এই অবস্থায় R ও W পরস্পর সমান ও বিপরীতমুখী হওয়ায় উভয় উভয়কে নিষ্ক্রিয় (balance) করবে। ফলে ব্লকটি স্থির থাকবে এবং কোনো ঘর্ষণ বলও থাকবে না। এখন যদি ব্লকটার ওপর টেবিলের সমান্তরাল সামান্য বল F প্রয়োগ করা হয় তা হলেও দেখা যাবে যে ব্লকে গতির সঞ্চার হচ্ছে না। যদিও R ও W টেবিলের তলের সাথে লম্ব হওয়ায় এবং F-এর সমান্তরাল আর কোনো বল না থাকায় ব্লকে গতির সঞ্চার হওয়া উচিত ছিল। এখন F বলকে যদি আমরা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করতে থাকি তাহলে দেখা যাবে F-এর একটা নির্দিষ্ট মানের জন্য ব্লকটি গতিশীল হওয়ার উপক্রম হবে। এই নির্দিষ্ট মানের চেয়ে বেশি প্রয়োগ করলে ব্লকটিতে গতির সঞ্চার হবে। আমরা বলতে পারি যে, বল প্রয়োগেও ব্লকটি গতিশীল না হওয়ার কারণ ব্লক ও টেবিলের মধ্যবর্তী ঘর্ষণ বল, fn। এখন FR-এর মান যে সীমায় পৌঁছলে ব্লকে গতির সঞ্চার হওয়ার উপক্রম হবে সেই সীমায় বস্তুদ্বয়ের মধ্যবর্তী আপেক্ষিক গতিকে বাধাদানকারী ঘর্ষণ বলের মান সর্বাধিক হবে। ধর্ষণ বলের এই মানকে সীমান্তিক মান বা সীমান্তিক ঘর্ষণ বলে।

চিত্র : ৪.২৯

 

সংজ্ঞা : কোনো তলের ওপর অবস্থিত কোনো বস্তুকে গতিশীল করার জন্য বস্তুর ওপর যে বল প্রয়োগ করলে বস্তুটিতে গতির সঞ্চার হওয়ার উপক্রম হয়, সেই সময় বস্তুদ্বয়ের মধ্যবর্তী আপেক্ষিক গতিকে বাধাদানকারী ঘর্ষণ বলের মানকে সীমান্তিক ঘর্ষণ বল বলে। 

যতক্ষণ পর্যন্ত ব্লকটি স্থির থাকে বা ব্লক ও টেবিলের মধ্যে কোনো আপেক্ষিক গতি না থাকে তখন বস্তুদ্বয়ের মধ্যে যে ঘর্ষণ কাজ করে তাকে স্থিতি ঘর্ষণ বলে। স্থিতি ঘর্ষণের মান শূন্য থেকে সীমান্তিক মান পর্যন্ত হতে পারে। 

সংজ্ঞা : কোনো তল এবং এই তলের ওপর অবস্থিত কোনো বস্তুর মধ্যে আপেক্ষিক গতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত যে ঘর্ষণ বল ক্রিয়া করে তাকে স্থিতি ঘর্ষণ বল বলে।

 

স্থিতি ঘর্ষণ গুণাঙ্ক

সংজ্ঞা : দুটি বস্তু পরস্পরের সংস্পর্শে থাকলে স্থিতি ঘর্ষণের সীমান্তিক মান ও অভিলম্বিক প্রতিক্রিয়ার অনুপাতকে স্থিতি ঘর্ষণ গুণাঙ্ক বলে।

স্থিতি ঘর্ষণের সীমান্তিক মান fx, এবং অভিলম্বিক প্রতিক্রিয়া R হলে স্থিতি ঘর্ষণ গুণাঙ্ক হবে μs,

μs=fsR

যে কোনো দুটি তলের মধ্যবর্তী স্থিতি ঘর্ষণ গুণাঙ্কের মান সব সময় । এর চেয়ে ছোট হয়। মাত্রা ও একক : একই জাতীয় দুটি রাশির অনুপাত হওয়ায় ঘর্ষণ গুণাঙ্কের কোনো মাত্রা বা একক নেই।

স্থিতি ঘর্ষণের সূত্রাবলি

দুটি অমসৃণ তলের মধ্যে যে স্থিতি ঘর্ষণ ক্রিয়া করে তা কতগুলো সূত্র মেনে চলে । এদেরকে স্থিতি ঘর্ষণের সূত্রাবলি বলা হয়।

চিত্র :৪.৩০

 

১. ঘর্ষণ বল সর্বদা গতির বিরুদ্ধে ক্রিয়া করে।

২. স্থিতি ঘর্ষণ বলের সীমান্তিক মান অভিলম্বিক (Normal)

প্রতিক্রিয়ার সমানুপাতিক ।

৩. স্থিতি ঘর্ষণ বল স্পর্শতলের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে স্পর্শ তলের ক্ষেত্রফলের ওপর নয়।

ঘর্ষণ কোণ

Angle of Friction

সীমান্তিক ঘর্ষণের ক্ষেত্রে অভিলম্বিক প্রতিক্রিয়া R ও ঘর্ষণ বল f-কে সংযোজিত করে যে লব্ধি বল পাওয়া যায় তাকে লব্ধ প্রতিক্রিয়া বলে।

সংজ্ঞা : সীমান্তিক ঘর্ষণের ক্ষেত্রে অভিলম্বিক প্রতিক্রিয়া এবং ঘর্ষণ বলকে সংযোজন করে যে লব্ধ প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় সেটি অভিলম্বিক প্রতিক্রিয়ার সাথে যে কোণ উৎপন্ন করে তাকে ঘর্ষণ কোণ বলে।

ব্যাখ্যা : ৪.৩০ চিত্রে সীমান্তিক ঘর্ষণ, j, ও অভিলম্বিক প্রতিক্রিয়া, R-কে সংযোজন করে লব্ধ প্রতিক্রিয়া S পাওয়া গেল এই লব্ধ প্রতিক্রিয়া S ও অভিলম্বিক প্রতিক্রিয়া R-এর মধ্যবর্তী কোণ λ হচ্ছে ঘর্ষণ কোণ (চিত্র ৪.৩০)।

 

স্থিতি বা নিশ্চল কোণ

Angle of Repose 

সংজ্ঞা : অনুভূমিকের সাথে কোনো তল যে কোণ উৎপন্ন করলে আনত তলের উপরস্থ কোনো বস্তু গতিশীল হওয়ার উপক্রম হয় সেই কোণকে ঐ তলে বস্তুটির স্থিতি বা নিশ্চল কোণ বলে । 

যে কোনো তলের আনতি স্থিতি কোণ পর্যন্ত হলে এই তলের ওপর বস্তু স্থির থাকবে। আনতি স্থিতি কোণ অতিক্রম করে গেলে বস্তুতে গতি সঞ্চার হবে।

চিত্র :৪.৩১

 

ব্যাখ্যা : 

৪.৩১ চিত্রে A ব্লকটি OX আনত তলের ওপর বসানো আছে। অনুভূমিক রেখার সাথে OX তলের আনতি ইচ্ছামত পরিবর্তন করা যায়। ব্লকের ওজন W ও ঘর্ষণ বল J, । এখন OX তলের আনতি বাড়াতে বাড়াতে যখন আনতি হয় তখন A ব্লকটি গতিশীল হওয়ার উপক্রম হয়। এই সীমান্তিক অবস্থায় আমরা লিখতে পারি—

R = W cos θ এবং fs = W sinθ

গতীয় ঘর্ষণ

Kinetic Friction

সংজ্ঞা : দুটি স্পর্শতলের মধ্যে যখন আপেক্ষিক গতি থাকে, তখন তাদের মধ্যে যে ঘর্ষণ ক্রিয়া করে তাকে গতীয় ঘর্ষণ বলে।

পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, চলমান অবস্থায় ঘর্ষণ বল বস্তুর স্থিতি ঘর্ষণ বলের সীমান্তিক মানের চেয়ে কম।

গতীয় ঘর্ষণের সূত্রাবলি

১. গতীয় ঘর্ষণ বল অভিলনিক প্রতিক্রিয়ার সমানুপাতিক। এখানে ঘর্ষণ বল সীমান্তিক ঘর্ষণ বলের চেয়ে কম।

২. গতীয় ঘর্ষণ বল স্পর্শতলের ক্ষেত্রফলের ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে গায়ের প্রকৃতির ওপর। ৩. বেগ খুব বেশি না হলে গতীয় ঘর্ষণ বল তলদ্বয়ের বেগের ওপর নির্ভরশীল নয়।

গতীয় ঘর্ষণ গুণাঙ্ক

সংজ্ঞা : কোন বস্তু যখন অপর একটি বস্তুর ওপর দিয়ে স্থির বেগে চলতে থাকে গতীয় ঘর্ষণ বল এবং অভিলম্বিক প্রতিক্রিয়ার অনুপাতকে গতীয় ধর্ষণ গুণাঙ্ক বলে।

 গতীয় ঘর্ষণ বল fk এবং অভিলম্বিক প্রতিক্রিয়া R হলে, গতীয় ঘর্ষণাঙ্ক μk হবে,

μk=fkR

m ভরের একটি বস্তুর উপর F অনুভূমিক বলের প্রয়োগে গতিশীল হয়। যদি fk গতীয় ঘর্ষণ বল বস্তুটির গতিতে বাধা সৃষ্টি করে তাহলে বস্তুটির ত্বরণ নিম্নোক্ত সমীকরণ থেকে পাওয়া যায়,

F-fk=ma

আবর্ত ঘর্ষণ

Rolling Friction

সংজ্ঞা : যখন কোনো বস্তু অপর একটি তলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যায় তখন গতির বিরুদ্ধে যে ঘর্ষণ ক্রিয়া করে। তাকে আবত ঘর্ষণ বলে।

বস্তুটি যখন কোনো তলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যায় তখন বস্তুটির চাপে ভারবাহী তলটির খানিকটা অংশ অবনমিত হয়। ফলে পড়িয়ে চলা বস্তুর ঠিক সামনে ঐ তলের খানিকটা অংশ BA উঁচু হয়ে যায় (চিত্র : ৪.৩২)

চিত্র :৪.৩২

বস্তুটি যতক্ষণ গড়িয়ে চলতে থাকে ততক্ষণ এরূপ উঁচু হয়ে ওঠা বাধাকে অতিক্রম করে যেতে হয় ফলে আবর্ত ঘর্ষণের উৎপত্তি হয়। বস্তুটি অপর বস্তুর ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলার সময় যদি অভিলম্বিক প্রতিক্রিয়া R এবং আবর্ত ঘর্ষণ fr, হয় তাহলে, আবর্ত ঘর্ষণাঙ্ক,

μr=frR

আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা দেখতে পাই যে, একটা বাক্সকে শুধু মেঝের ওপর দিয়ে টেনে নিতে যত কষ্ট হয় তার চেয়ে অনেক কম কষ্ট হবে যদি বাক্সের তলায় অনেকটা রোলার লাগিয়ে দেয়া যায়। কাজেই আমরা বলতে পারি, আবর্ত ঘর্ষণ গতীয় ঘর্ষণের চেয়ে অনেক কম।

৪.২৮ প্ৰবাহী ঘর্ষণ

Fluid Friction

যখন কোনো তরল পদার্থ বা বায়বীয় পদার্থের গতিপথে কোনো স্থির বস্তু রাখা হয় বা কোনো বস্তুকে তরল বা বায়বীয় পদার্থের মাঝ দিয়ে গতিশীল হতে হয় তখন উভয়ের মধ্যে ঘর্ষণ উৎপন্ন হয়। এই ধরনের ঘর্ষণকে প্রবাহী ঘর্ষণ বলে। সাধারণত জাহাজ পানিতে চলার সময়ে বা বৃষ্টির ফোঁটা বাতাসের মাঝ দিয়ে পড়ার সময়ে এই ধরনের ঘর্ষণের উৎপত্তি হয় ।

৪.২৯। ঘর্ষণের সুবিধা ও অসুবিধা

Advantage & Disadvantage of Friction

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঘর্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ঘর্ষণ না থাকলে আমরা হাঁটতে পারতাম না, পিছলে যেতাম। কাঠে পেরেক বা স্ক্রু আটকে থাকতো না, সম্ভব হতো না দড়িতে কোনো গিরো দেয়া। কোনো কিছু আমরা ধরে রাখতে পারতাম না। ফলে সহজেই বোঝা যায়, ঘর্ষণ না থাকলে আমাদের কতটা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতো।

ঘর্ষণের জন্য আমাদেরকে অসুবিধাও কম পোহাতে হয় না। যন্ত্র চলার সময় গতিশীল অংশগুলোর মধ্যে ঘর্ষণ ক্রিয়া করার ফলে ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। তাছাড়া যান্ত্রিক দক্ষতাও বেশ কমে যায়, আবার ধর্ষণের ফলে অনাবশ্যক তাপ উৎপাদনের জন্যও যন্ত্রের ক্ষতি হয়।

এসব অসুবিধা দূর করার জন্য যন্ত্রপাতির স্পর্শতলগুলোর মাঝে পিচ্ছিলকারী বা গ্রাফাইট ব্যবহার করে পিচ্ছিল রাখা হয়।

সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় সমীকরণসমূহ

 

Content added || updated By

আরও দেখুন...

Promotion

Promotion